শিশুর জীবনে মায়ের বুকের দুধের কোনও বিকল্প নেই। মায়ের দুধ শিশুর
জীবনে আশীর্বাদস্বরূপ। আল্লাহ তায়ালার অফুরন্ত নিয়ামত। এ দুধ শিশুর সবচেয়ে নিরাপদ, পুষ্টিকর, স্বাস্থ্যসম্মত
ও আদর্শ খাবার। ইসলাম শিশুকে মায়ের দুধ পান করার বিষয়ে জোর তাগিদ প্রদান করেছে। এটা
শিশুর জন্মগত অধিকার ও আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্ত। এ কারণে জীবনের নিরাপত্তার চরম হুমকি
থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ তায়ালা হজরত মূসা (আ.)-এর মায়ের কাছে প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছিলেন।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
‘আমি মূসার মায়ের কাছে নির্দেশ দিলাম যে, তুমি তাকে
দুধ পান করাও। ’ –সূরা
আল কাসাস: ৭
শিশুর জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে মায়ের বুকের দুধ দিতে হবে। মায়ের শাল দুধ শিশুর জন্য খুব উপকারী। মায়ের বুক থেকে হলুদাভ ঘন-আঁটল যে দুধ বেরিয়ে আসে তাই শাল দুধ।
বাচ্চা কেন দুধ খেতে চাই না:
বাচ্চা জন্মের পর বাচ্চা মায়ের দুধ মুখে না নেয়া বা দুধ খেতে না চাওয়ার
প্রবণতা বেশি থাকে। গ্রামাঞ্চলে এই সমস্যাকে বলে দুধ নষ্ট হওয়া। এই সমস্যা আমাদের দক্ষিণ
এশিয়া মহাদেশে বেশি দেখা যায়,
কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য বা আরব দেশ গুলোতে আবার এই সমস্যা দেখা যায়
না। সকল মা এই সমস্যা ভোগ করে না, কিন্তু প্রায় ৩০% মা তার সন্তান নিয়ে এই সমস্যা ভোগ করে থাকেন। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় ১০০ জন নারীর মধ্যে ৩০ জন নারী এই সমস্যা ভোগ করে থাকেন। আজকে আমরা জানার চেষ্টা করবো এই সমস্যার কারণ এবং প্রতিকারের উপায়। এই সমস্যার প্রধান কারণ হচ্ছে মায়ের
স্তনের উপর অন্য পুরুষ বা নারীদের দৃষ্টি পড়া। আমাদের উপমহাদেশে গ্রামে বা শহরে বাচ্চা
প্রসবের নারীরা উন্মুক্ত ভাবে দুধ পান করিয়ে থাকে ফলে মায়ের স্তনের উপর মা, খালা, দাদি, বোন, নিকট আত্মীয়
বা দূর আত্মীয় অনেক মহিলার নজর পড়ে। যেটি মায়ের দুধ কমে যাওয়া ও সন্তান দুধ খেতে না
চাওয়ার অন্যতম কারণ। ইসলাম এই বিষয়ে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছে। কারণ একজন মহিলা
যেমন পুরুষের থেকে তার সতর ঢেকে রাখতে হয় তেমনি ভাবে মহিলা থেকেও ঢেকে রাখতে হয়। মহিলাদের
স্তন, গোপনাঙ্গ
সর্বাপেক্ষা প্রধান সতর। সুতরাং এটি স্বামী বা নিজের জন্মগত মা ছাড়া অন্য করোও সামনে
অনাবৃত হলে আল্লাহর রহমত এবং বরকত কমে যায়। শয়তান এতে আনন্দিত হয় ফলে বাচ্চা দুধ খেতে
চাই না, কিংবা
দুধ কমে যায়। সাধরণত একটি শিশু জন্ম গ্রহণ করার সাথে সাথেই তার সাথে ফেরেশতা এবং শয়তান দুই সংমিশ্রণের ক্ষেত্র শুরু হয়ে যায়। শিশু জন্মের পর প্রথমেই শয়তান তার নিকটে ছুটে আসে, কিন্তু শিশুর কানে আজান দিলে শয়তান দৌড়ে পালিয়ে যায় এবং সেই সময়ের জন্য রহমতের ফেরেশতাদের জয় হয়। মা যখন তার স্তন খোলা অবস্থায় কারও সামনে দুধ খাওয়ায় বা স্তন খোলা রাখে বা তার গোপনাঙ্গ উন্মুক্ত করে তখন শয়তান আবার ফেরত আসার সুযোগ পায়। এমন অবস্থায় রহমতের ফেরেশতা শিশুর নিকট থেকে দূরে চলে যায় এবং শিশু আবার শয়তানের নিয়ন্ত্রনে পড়ে যায়। শয়তানের প্ররোচনায় এই সময় শিশু অসস্তিতে ভোগে এবং কান্না করতে থাকে। অনেক সময় ঝাড় ফুক করলে এই সমস্যা কিছু দিনের জন্য সমাধান হয় কিন্তু কিছু
দিন পর এই সমস্যা আবার সৃষ্টি হতে পারে।
স্তন অন্য নারী বা পুরুষের সামনে অনাবৃত করে দুধ খাওয়ালে দুধ নিজে
নিজে ঝরে পড়ার কারণও তৈরি হতে পারে এবং মায়ের স্তনের দুধ শুকিয়ে যেতে পারে। ইসলাম পূর্ব আরবে নারীদের মাঝে এই প্রথা ছিল যে, তারা এক
বা একাধিক নারী একত্রে বসে দুধ খাওয়াতো। তারা বোন, দাদি, চাচি, খালা, বা মহিলাদের সামনে দুধ খাওয়াতো, ফলে তাদের
মাঝে দুধ অপচয় ও দুধ নষ্টের প্রভাব ছিল। কিন্তু ইসলাম বিজয়ের পর নারীরা পূর্ণ পর্দা
করলে এই সমস্যা কমে যায়। পর্দার কারণে আরব বিশ্বে এখন আর এই সমস্যা দেখা যায় না।
খাবার ঢেকে না রাখলে যেমন খোলা খাবারের কারণে শিশুরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়, ঠিক তেমনি অনাবৃত স্তনে অন্য কোনও মানুষের সামনে দুধ খাওয়ালে শিশু বমি, পায়খানা, ডায়রিয়া, পেটফাপা, বদহজম সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আর এই সব কারণে মধ্যপ্রাচ্য তথা আরব অঞ্চেলের চেয়ে আমাদের দেশে শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি।
প্রতিকার:
# যথাসম্ভব
চেষ্টা করুন একাকী পর্দার সহিত দুধ পান করাতে, যাতে কেউ আপনার স্তন, বক্ষ বা
সতর দেখতে না পায়।
# দুধ
পানের সময় আপনার বাচ্চার শরীরের উপর দিয়ে একটি চাদর কিংবা শাড়ী জাতীয় আচ্ছাদিত করে
দিন, যাতে
হঠাৎ কোনও নারী বা পুরুষ ঘরে চলে আসলে যেন সে আপনার শরীর দেখতে না পায়।
# যদি
একা সম্ভব না হয় তবে নিজের মা যদি স্বামীর বাড়ি থাকে তবে নিজের শাশুড়ি বা স্বামীর মায়ের
সাহায্য নেয়া যাতে পারে। কিন্তু এর বাইরে কাউকে স্তন দেখানে যাবে না।
# যদি
অনেক মহিলার মাঝে বসা অবস্থায় বাচ্চা দুধ খেতে চাই তবে সেখান থেকে উঠে গিয়ে একাকী অন্য
ঘরে বাচ্চাকে পর্দার সহিত দুধ খাওয়াতে হবে।
# এই
সময় বেশি বেশি দোয়া করতে হবে। নামাজ বন্ধ থাকাকালীন সময়ে মুখে দোয়া পড়তে কোনও নিষেধাজ্ঞা
নেই।
# একাকী
ছাড়া কখনও দলবদ্ধ ভাবে বা অন্যের সাথে স্তন অনাবৃত করে দুধ পান করানো যাবে না।
# মনে রাখবেন আপনি যত ইসলামি বিধান পালন করবেন, আল্লাহ আপনার উপর তত বরকত নাজিল করবেন।
ইসলামের প্রথম যুগের নারীগণ আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান এবং কুরআন
ও সুন্নাহর অনুসরণের বরকতে পুতঃপবিত্রতা, লজ্জাশীলতা ও শালীনতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিলেন।
সে সময়ে নারীগণ পরিপূর্ণ শরীর আচ্ছাদনকারী পোশাক পরতেন। নারীদের সামনে অবস্থানকালে
তারা খোলামেলা চলতেন বা অনাবৃত থাকতেন বলে জানা যায় না। শতাব্দীর পর শতাব্দী, প্রজন্মের
পর প্রজন্ম, এমনকি
নিকট অতীত পর্যন্ত মুসলিম নারীসমাজ এভাবেই চলে এসেছেন। এরপর নানা কারণে অনেক নারীর
মধ্যে পোশাক ও চরিত্রের অবক্ষয় শুরু হয়েছে।
এছাড়াও শিশু যদি পেটের পিড়ায় ভোগে কিংবা মা'য়ের দুধ যদি পর্যাপ্ত না হয় তবে বাচ্চা দুধ খেতে অনিহা প্রকাশ করতে পারে। অনেক সময় কালো যাদুর প্রভাব, শয়তানি ক্রিয়া কলাপের কারণেও বাচ্চা দুধ না খেতে পারে। এই প্রথা এক সময় প্রাচীন ভারতে প্রচলিত ছিল হিন্দু সমাজের মধ্যে, কিন্তু এটি বর্তমানে তেমন ভাবে আর দেখা যায় না। বিশেষ করে বর্তমানে ভারত কিংবা বাংলাদেশ পাকিস্তানেও সেই ধরনের আর প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না।
এবার আসা যাক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়। চিকিত্সাবিজ্ঞানের ভাষায়, শাল দুধকে ‘কোলোস্টাম’ বলে। এ
দুধে স্নেহ ও শর্করার পরিমাণ থাকে কম। তবে খনিজ লবণ, লৌহ, রোগপ্রতিরোধী পদার্থ ও আমিষের পরিমাণ সাধারণ
দুধের চেয়ে বেশি থাকে। মায়ের দুধ গ্রহণকারী শিশুদের এলার্জি, ব্যাকটেরিয়া
ও ভাইরাসজনিত সংক্রমণ, ডায়রিয়া, যক্ষ্মা, মেনিনজাইটিস, অন্ত্রপ্রদাহ
জাতীয় রোগের প্রাদুর্ভাব অন্য শিশুদের তুলনায় অনেক কম হয়। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ
করেন, ‘শিশু
জন্মের পরপর মায়ের বুক থেকে যে দুধ আসে তা শিশুর জন্য অত্যন্ত সুষম, উপাদেয়
ও উপকারী খাবার। ’ –সুনানে
তিরমিজি
জন্মের পর শিশু এক-দেড় বছর বয়স পর্যন্ত খুব দ্রুত বাড়ে। ওই সময়
তার বাড়ন্ত শরীরের চাহিদা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টির প্রয়োজন। আর নবজাতকের
পুষ্টি বলতে মায়ের দুধকেই বোঝায়। এ দুধ কমপক্ষে ছয় মাস পর্যন্ত শিশুকে খেতে দিতে হবে।
ছয় মাস পর মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি অন্য খাবারেরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে। মনে রাখতে
হবে, শিশুর
ওপর মায়ের প্রভাব পড়ে থাকে। সুতরাং এ সময় মাকে নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হতে
হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। শিশুর যাতে দুধের অসুবিধা না হয়। নবজাতক যেহেতু
জন্মের পর অন্যান্য প্রাণীর মতো নিজে খাদ্য সংগ্রহ করে খেতে পারে না, সেহেতু
ইসলামি শরিয়ত শিশুর জন্য দুই বছর পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ পান করার অনুমোদন করেছে।
এ মর্মে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দু’বছর দুধ
পান করাবে। ’ –সূরা
আল বাকারা: ২৩৩
ইসলামে মায়ের দুধের গুরুত্বের বিষয়টি। ইসলাম বুকের দুধ খাওয়ানো
প্রতিটি মায়ের জন্য ওয়াজিব করেছে। যারা সফলভাবে এই ওয়াজিব পালন করবে তাদের জন্য রয়েছে
বিশেষ পুরস্কার।
মাতৃদুগ্ধ পানে শিশুর স্মরণশক্তি, বুদ্ধিমত্তা, চোখের
জ্যোতি, আচার-ব্যবহার, সামাজিকতা
ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার সুন্দর বহিঃপ্রকাশ হয়। যে নবজাতকের মা শিশুকে দুধ পান করান, তার জন্য
মাহে রমজানের রোজা পালনের বাধ্যবাধকতা পর্যন্ত শিথিল করে দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
‘আল্লাহ মুসাফিরের ওপর থেকে চার রাকাতবিশিষ্ট নামাজের অর্ধেক রহিত
করে দিয়েছেন এবং মুসাফির,
স্তন্যদানকারিণী ও গর্ভবতী মহিলা থেকে রমজানের রোজা পালন করার
বাধ্যবাধকতাও শিথিল করে দিয়েছেন। ’
–সুনানে তিরমিজি,
আবু দাউদ ও নাসাঈ
ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃদুগ্ধ নবজাত শিশুর জন্মগত অধিকার। যাতে কোনো কারণে এটি খর্ব না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কেননা ‘আজকের শিশু, আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’। অভিভাবকের দায়িত্ব হচ্ছে মাতৃদুগ্ধ দানকে উন্নয়ন ও সহায়তা করা। ভবিষ্যৎ কর্ণধার শিশুদের মানবাধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে মায়েদের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। মাতৃদুগ্ধ যাতে শিশুরা নিয়মিত পায় এ জন্য মায়েদের মধ্যে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। মায়ের দুধের অনন্য ভূমিকার কথা আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞান মায়ের দুধ খাওয়ানোর ওপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করছে। বিষয়টি মায়েরা মন দিয়ে উপলদ্ধি করলেই মঙ্গল।